ধর্ষিতাকে দোষী
সাব্যস্ত করায় ধর্ষণের
প্রবণতা বাড়ছে!
ভায়লেট হালদার
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে বইছে
আনন্দের বন্যা। গ্রামের
গণ্যমান্যজন একত্রিত হয়েছে একজন
নারীকে পেটাতে।
এই নাগরপুরের নাগরেরা লজ্জাহীন
মুখমণ্ডল প্রদর্শন করে একজন
নারীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তারই উপর
অকথ্য ভাষায় উক্তি ছুঁড়ে দিচ্ছে।
লাঠি দিয়ে পেটাতে নারীর
পরিবারকে বাধ্য করেছে স্থানীয়
সালিশ বিচারে, এটি একটি কৌশল
— যাতে সালিশকারী নির্যাতকরা
প্রত্যক্ষভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়া
থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে
।
দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত
ছবিটি দেখলে মনে হবে কোন
আনন্দের ঘটনা ঘটছে। নিশ্চয়
একমাত্র নারীর মুখমণ্ডলটিতে
বেদনার চিত্র ফুটে উঠেছে, তার
ভারাক্রান্ত মনের নিঃশব্দ কষ্ট
যেন চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে
চাইছে। সেদিকে কারো কোন
ভ্রুক্ষেপ নেই। নারী এখানে
অপরাধী, সে মস্ত বড় অপরাধ করে
ফেলেছে।
সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটাই
তার অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি
তাকে পেতেই হবে। সালিশকারী
পুরুষেরা শারীরিক ও মানসিক
নির্যাতনের পরে তাকে পনের
হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
আর এই জরিমানার টাকা স্থানীয়
ক্লাবের উন্নয়নে ব্যয় হবে।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি।
আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার
হয়ে বেঁচে থাকে শিশুকন্যা থেকে
বৃদ্ধা নারী। নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে
তার দেহ ভোগ করে আবার সেই
ধর্ষিতা নারীকে দাঁড় করানো হয়
বিচারের মুখোমুখি। বর্তমান সময়ে
সবচেয়ে বেশী নারী ধর্ষণের
শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে, এবং
বেড়েই চলেছে ধর্ষণের বিচারের
নামে ধর্ষিতাকে শারীরিক ও
মানসিক নির্যাতন, অর্থ জরিমানা
এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষকের
সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দেয়া হচ্ছে
জোর করে।
একবিংশ শতাব্দীর
সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত
লোকেরা ধর্ষিতাকে শাস্তি
দেওয়া মেনে নেয়, এবং উচিত বলেও
মনে করে অনেকে। ধর্ষণের শিকার
হওয়ার জন্য যেন ধর্ষিতা নারীই
দায়ী। এ সমাজের পুরুষেরা
ধর্ষিতা নারীর দোষ খুঁজতে থাকে।
মুখে মুখে আলোচনা চলে নারীর
পোশাক নিয়ে, নারী কেন একা
বাইরে যাবে? নিশ্চয়ই নারীর
সম্মতি ছিল, না থাকলে ধর্ষণ করা
সম্ভব নয়। অতিরিক্ত সাজসজ্জা ও
বোরখা হিজাব পরিধান না করা।
পুরুষ মানুষ ছাড়া ঘরের বাইরে পা
রাখা…ইত্যাদি সব আপত্তিকর
মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় ধর্ষিতা ও তার
পরিবারের প্রতি।
কিন্তু সমাজের লোকেরা একবারও
ভেবে দেখে না, ধর্ষণের শিকার
নারীদেরকে দোষারোপ করার
মানসিক প্রবণতাও যে ধর্ষণ বৃদ্ধির
কারণ। কোন নারী যদি ধর্ষণের
শিকার হয়, তাহলে তাকেই উল্টো
দোষটা নারীর ঘাড়েই চাপিয়ে
দেয়া হয়। কিন্তু কেন?
৬৪ জেলার ৬৮ হাজার গ্রামের
বাংলাদেশে নারীর দুঃখ ও
দুর্দশার চিত্র সর্বত্রই স্পষ্ট
প্রতীয়মান। যে সমাজে নারীর
শরীরে খোঁজা হয় সতীত্বের চিহ্ন
সে সমাজেই নারীর শরীর ভোগ
করে নারীর সম্ভ্রমহানী করে
তাকেই করা হয় শারীরিক ও
মানসিক নির্যাতনের শিকার। এবং
নারীর উপর চলে আসা এ নির্যাতন
যেন সামাজিক প্রথা হয়ে
দাঁড়িয়েছে।
ঘরে-বাইরে প্রকাশ্যে আজ নারী
নির্যাতিত হচ্ছে। নারী নির্যাতন
যেমন বেড়েছে তেমনি এর মাত্রা ও
ধরণ ভয়াবহ; পথে-ঘাটে, বাড়িতে
উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি করে আবার
সালিশের মাধ্যমে নারীকে
শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা
একাধিক ঘটনা ঘটে চলেছে
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন
প্রান্তে।
বছর বছর ধরে বাংলাদেশের নারী
প্রতি যৌননির্যাতনের অপ্রীতিকর
ও ভয়ংকর চিত্র আমরা দেখি তার
মধ্যে প্রচুর ঘটনা আছে যা গ্রাম্য
সালিশ, ফতোয়া প্রদান ও তার
প্রয়োগের ফলে ঘটছে। জুতোপেটা
করা, দোররা মারা, পাথর নিক্ষেপ,
হিল্লা বিয়ে দেয়া, একঘরে করে
রাখা, মুখে চুনকালি মেখে
জনসম্মুখে প্রদর্শন, জানাজা না
দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ফতোয়া
দেয়া চলছেই। ফলে অনেক নারী
তার পরিবারসহ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য
হচ্ছে।
ফতোয়া একটি সামাজিক ব্যাধি,
যার মূলে আছে কিছু ধর্মীয় গোঁড়া
মানুষ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা,
প্রথামুখিনতা ও অপ্রগতিশীল
চিন্তা ও চেতনা। বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে ফতোয়া প্রদান করা
হয় নারী-পুরুষের শারীরিক
মেলামেশাকে (অবৈধ) কেন্দ্র
করে। সেক্ষেত্রে প্রথম আক্রমণের
শিকার হচ্ছে নারী এবং পিছিয়ে
পড়ছে নারীরাই।
আমাদের সমাজে কতিপয় লোক
যেমন গ্রামের মাতব্বর, মাদ্রাসা
শিক্ষক, মোল্লা, মসজিদের ইমাম,
মুয়াজ্জিন, স্থানীয় চেয়ারম্যান,
ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার,
স্থানীয় প্রভাবশালী লোক,
গ্রামের স্কুলশিক্ষক, গ্রাম্য
ডাক্তার যার যেমন ইচ্ছেমত
ফতোয়া দিয়ে গ্রাম্য সালিশ-
বিচারের নামে নির্যাতিতের উপর
চালাচ্ছে আরেক দফা নির্মম
নির্যাতন। আর সমাজের বহু অসহায়,
হতভাগ্য ও সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র
শ্রেণীর নারীরা সেই ফতোয়ার
শিকার হচ্ছে।
সালিশ হল মহল্লা ও গ্রামভিত্তিক
স্থানীয় লোকসমাজের বিচার
ব্যবস্থা; গ্রামের চেয়ারম্যান,
মেম্বার, মাতবর ও স্থানীয়
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে
বিচারসভা। প্রাচীনকাল থেকে
বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে
গ্রামপ্রধান সমাজে প্রধানত যে
দু’ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত
তার একটি হলো সালিশ, অন্যটি
হলো সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে
রাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় শাখার
কার্যক্রম।
স্থানীয় পর্যায়ের ছোটখাট
বিরোধগুলি এখন বর্ধিত হারে
নিয়মিত গ্রামআদালতের বাইরে
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/
সদস্যদের নিকট নিষ্পত্তির জন্য
উত্থাপন করা হয়, স্থানীয় সরকার
বা ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তাদের
পরিচালিত ঘরোয়া সালিশে তা
মীমাংসা করা হয়। কিন্তু
গ্রামভিত্তিক সালিশের বেলায়
তীব্র দলাদলি, রেষারেষি,
রাজনৈতিক বিবেচনা ও
প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে স্থানীয়
সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদের
কর্মকর্তাদের পরিচালিত ঘরোয়া
সালিশে ব্যাপক দুর্নীতির ইঙ্গিত
পাওয়া যায়।
অধিকাংশ সালিশ পরিচালনায়
সংশ্লিষ্ট আইন বা স্বীকৃত
নীতিমালার প্রতি যথাযথ
মনোযোগ দেওয়া হয় না। বিত্তবান
ও প্রভাবশালী মহলের চাপ, অর্থের
প্রভাব বা বিশেষ অনুগ্রহ, স্থানীয়
সন্ত্রাসীদের ভয় এবং গোঁড়া
ধর্মীয় অভিমতের আধিপত্য
বিস্তার সালিশে ন্যায়বিচার
পাওয়ায় মূখ্য অন্তরায় হয়ে ওঠে।
আর ফতোয়া বিষয়টি হচ্ছে মান্য
করার একটি বিষয়। আরবি শব্দ
‘ফতোয়া’ এর অর্থ ‘জিজ্ঞাসা’ বা
‘আইন সম্পর্কিত মত’।
ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ বা মুফতি
প্রদত্ত ও প্রকাশিত বিধানকে
ফতোয়া বলে। কিন্তু বর্তমানে
ফতোয়ার রূপ একেবারেই ভিন্ন।
যেখানে সালিশ (কর্তাব্যক্তিরা)
কখনো কখনো নিজ স্বার্থে
অমানবিক ‘ফতোয়া’ (যা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর
বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়) কার্যকর করার
হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।
আর এসব ফতোয়া জারি করেন
স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা। এরপরেও
বাংলাদেশের অনেক এলাকায় ও
গ্রামপর্যায়ে সালিশ সক্রিয়
রয়েছে। ফতোয়া যেন একটি
সামাজিক ব্যধিতে রূপান্তরিত
হয়েছে।
একশ্রেণির সুবিধাভোগী লোভী
মানুষ নারীকে দমিয়ে রাখতে,
নির্যাতন করতে, নারীর
অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে,
নারীর চলার পথকে সঙ্কীর্ণ করে
তোলার জন্য নিজেদের মনগড়া কিছু
আইন তৈরি করে নারীদের ওপর
চাপিয়ে দিচ্ছে।
যদিও ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি
ফতোয়া নিয়ে দেয়া আপিল
বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত
হয়েছে। সে রায়ে বলা হয়েছে:
১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত
ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে
ফতোয়া দিতে পারবেন। এই
ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে।
ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা,
জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব
প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত
আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার,
সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুন্ন বা
প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ
প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার
শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক
নির্যাতন করা যাবে না।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়টি
প্রকাশিত হওয়ায় পরেও সরকার ও
মানবাধিকারকর্মীরা ফতোয়ার
বিরুদ্ধে শক্তভাবে ও যথাযথ কোন
পদক্ষেপ নিতে পারছেন না সমগ্র
বাংলাদেশ জুড়ে। ফতোয়া
প্রতিরোধের জন্য দরকার
গণসচেতনতা ও সমাজের সকল
প্রগতিশীল মানুষের সক্রিয় হয়ে
ওঠা। নয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের
পুরুষের অত্যাচারের ফলে নারী
মানবিকবোধের প্রকাশ থেকে
বঞ্চিতই থেকে যাবে।
বন্ধ হোক নারীকে যৌন নির্যাতন
এবং সালিশ বিচারের নামে
নারীকে অর্থদণ্ড ও শারীরিক-
মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে
নারী রক্ষা পাক। গ্রাম্য সালিশ
বিচারের নামে নির্যাতনকারীদের
আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান
করা হোক।
জয় হোক নারীর, ভাল থাকুক সকল
মানুষ।
ভায়লেট হালদার: নরওয়েপ্রবাসী
নারীবাদী এক্টিভিস্ট ও
কলামিস্ট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন