শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

'ভুল' কবি আল মাহমুদ

কাজল রশীদ শাহীন
কবি আল মাহমুদ কবি হিসেবে
যেমন সোনা ফলিয়েছেন,
প্রাবন্ধিক হিসেবে ততটা কি?
আল মাহমুদের প্রবন্ধে দেখা
মেলে ভিন্ন এক মাহমুদের, যার
সঙ্গে মেলানো যায় না
বাংলা ভাষার এ সময়ের
জীবিত প্রধান কবিকে…
কবিতা সৃজনের ঊষালগ্নে ও
প্রারম্ভপাদে আল মাহমুদ যতটা
অপরিহার্যরূপে হাজির
হয়েছিলেন বাংলা কবিতায়,
জ্যেষ্ঠ আল মাহমুদ ঠিক ততটা
কি? মননশীল সাহিত্যাকাশে
তিনি যেন নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ
রূপেই করেছেন উন্মীলন ও
অসংশয়িত। কবি আল মাহমুদ,
বিশেষ করে কালের কলস, লোক
লোকান্তর, সোনালী কাবিনের
কবি যত গম্য ও
শিরোপাপ্রশ্রয়ী, মনন আল
মাহমুদ ততটাই অগম্য ও
কণ্টকযুক্ত এক প্রাবন্ধিক।
আল মাহমুদের প্রবন্ধ মানে ও
গুণবিচারে দুর্বল শুধু নয়,
পাঠোপযোগিতাও প্রশ্নবিদ্ধ
এবং বিভ্রম উদ্রেককারী।
‘গোলাপে কাঁটা থাকে’
বাক্যটাকে আমরা এভাবেই
জানি, মানি ও রেখেছি
প্রবহমান। কিন্তু সেই বাক্যই
যদি এ রকম হয়ে যায় তাহলে
দাঁড়ায় কী, ‘কাঁটাতে গোলাপও
থাকে’। আল মাহমুদ, চিরায়ত ও
চিরন্তন এই সত্যকে দিয়েছেন
পাল্টে, করেছেন কুহকিত।
সৃজনশীল ও মননশীল সত্তার যে
আল মাহমুদ হাজির আমাদের
সাহিত্যভুবনে, সেখানে দেখা
যায় কাঁটায় গোলাপও থাকে।
আল মাহমুদ কবি হিসেবে
আমাদের কাছে
আবেদনবিস্তারি হলেও
প্রাবন্ধিক হিসেবে নয়। বরং
প্রাবন্ধিক আল মাহমুদ
আমাদের যে বার্তা দেন, তা
শুধু অগ্রহণীয় নয়; ভুল হিসেবেও
প্রতিভাত হয়। একজন কবির এই
অভীপ্সা ভয়ঙ্কর। এ কারণে
সৃজনশীল আল মাহমুদকে আমরা
সাহিত্যে যেভাবে গ্রহণ করতে
অভ্যস্ত, সেভাবে যদি মননশীল
আল মাহমুদকেও গ্রহণ করি,
তাহলে সেটা হবে আমাদের
জন্য সমূহ ক্ষতি ও সর্বনাশের
উদ্গাতাস্বরূপ। কারণ মননশীল
আল মাহমুদ সর্বদাই
উদ্দেশ্যপ্রবণ ও ইজমাক্রান্ত
এবং জ্ঞাত কিংবা
অজ্ঞাতসারেই হোক
স্ববিরোধী এবং অন্যের
দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ অন্যের
দৃষ্টিতে দেখা যে কতটা
ভয়ঙ্কর, তার স্বরূপ উন্মোচন
করেছেন নানাভাবে। আল
মাহমুদ সেটা করতে গিয়ে তার
কবি প্রতিভাকেও করেছেন
প্রশ্নবিদ্ধ ও হ্রস্ব। কালের
কলস, লোক লোকান্তর, সোনালী
কাবিনের পতাকাবাহী কবির
ইউটার্নের পরিণতি এভাবে
কালিমালিপ্ত হবে— তা
বোধকরি কেউ কস্মিনেও
করেনি কল্পনা। লোহিতাভ
মৃত্তিকার দেশের কবি, চুল
খোলা আয়েশা আক্তারের কবি
যে কাউকে আকৃষ্ট ও আপ্লুত
করবে— এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সেই আকর্ষণ ও আকণ্ঠ
বিস্তার যদি পুরো আল
মাহমুদের প্রতি হয়, তার সমগ্র
কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও
প্রবন্ধের প্রতি হয়, তাহলে
রয়েছে ভুল বার্তা পাওয়ার
শঙ্কা। আল মাহমুদে উঁকি
দেয়া, উড়াল দেয়া, এমনকি
উষ্ণতা নেয়ায় হয়তো নেই
সর্বনাশ ও সমস্যা। কিন্তু
তাতে স্নাত হলেই ঘটে যেতে
পারে পিচ্ছিলায়ন। কবির
মতোই ইউটার্নের দমকে হতে
পারে বুঁদ ও বস্ফািরিত এক অন্য
স্বরূপের কাণ্ডার-কারিগর।
পাখির মতো বন্য হতে চাওয়া
প্রেমিক প্রবর হয়ে যেতে
পারে দখলদার বখতিয়ারের
ঘোড়ার প্রণয়প্রার্থী। এ
কারণে আল মাহমুদ পাঠে সতর্ক
হওয়া জরুরি ও বাঞ্ছনীয়।
পুষ্প ও কণ্টক পাশাপাশি
থাকাটাই জগতের অনিবার্য
নিয়তি ও বিধান। তা নিয়ে
আমরা কখনই হই না উদ্বেলিত ও
সন্দেহপ্রবণ। কিন্তু যে বাগানে
পুষ্পকেই ছাড়িয়ে চাড়া দেয়
কণ্টক, সে বাগান নিশ্চয়ই হয় না
প্রিয়। আর যদি সেখানে থাকে
স্মৃতিযোগ, থাকে ফিদাযোগ
কিংবা অভ্যাসযোগ, তাহলে
তাতে হওয়া প্রয়োজন আশু
সতর্ক। এ কারণে জ্ঞাত হওয়া
প্রয়োজন নির্মাতার উদ্দেশ্য ও
বিধেয়। আল মাহমুদের উদ্দেশ্য
ও বিধেয় এক থাকেনি। অবশ্য
উল্টো সত্যও হাজির হতে পারে
এখানে।
তিনি সবর্দাই ছিলেন এক,
অভিন্ন ও অদ্বিতীয়।
সুবিধাবাদ ও সুযোগের প্রশ্নে
তিনি সর্বদাই ছিলেন খাপ
খোলা তলোয়ার। এ কারণে
মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তার গন্তব্য,
আশ্রয় ও আরশ হয়েছে বিপরীত
পন্থায়।
গণকণ্ঠের সম্পাদক আল মাহমুদ
তার ভূমিকাতে অনঢ় ও অবিচল
থাকেননি। এ কারণে বলা যায়,
তার সেই ভূমিকা ছিল হলুদ
সাংবাদিকতার প্রতিভূ। তিনি
বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতেও
যেমন কসুর করেননি, তেমনি
বঙ্গবন্ধুর কৃপাপ্রার্থী হতেও
রাখেননি কোনো হেলদোল।
প্রচলিত বিধি ও বিধানে যে
চাকরিতে তার নেই কোনো
অধিকার ও আবেদনযোগ্যতা,
সেই চাকরিই তাকে
দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তার পরও তার কেবলা বদল
হয়েছে বারংবার। এবং
শেষাবধি এমন এক কেবলায়
তিনি বিছিয়েছেন সৃজন
জায়নামাজ, তাতে বিকশিত ও
উপ্ত হয়েছে সোনালী
কাবিনের আল মাহমুদ নয়।
ক্ষুদিরামকে যিনি বলেছিলেন
একদা সোনার ছেলে, সেই আল
মাহমুদের বদলে গেছে
ইশতেহার এবং আওয়াজের
ব্যাকরণ ও ভাষারীতি। এ
কারণে পরিণত, জ্যেষ্ঠ আল
মাহমুদ সাহিত্যাকাশে
দ্বিভাজিত এক সত্তা।
কখনো তিনি আল মাহমুদ।
কখনো তিনিই আবার ‘ভুল’
মাহমুদ। এ কারণে আল মাহমুদ
পাঠ আনন্দদায়ক হলেও ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষ করে তার মননসাহিত্য।
আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের
নিবিড় পাঠ সমাপ্যে বিশ্লেষণ
ও পর্যালোচনা করলে আমাদের
কাছে ক্রমে স্পষ্ট ও উন্মোচিত
হয় যে সৃজন দূত, তিনি আর যা-ই
হোক কবি আল মাহমুদ নয়।
তিনি বিশেষ মিশনের
কারবারি। যেখানে সংকীর্ণ
এক সত্তার সৃজন কারিগর ভুল
বার্তা দেয়ার লাঠিয়ালি
জৌলুসে তার কায়মনো ভাবনা-
চিন্তা আরোপ ও লেপন করেছেন
নানাভাবে, নানা রূপে, নানা
ঢঙের বাদ্যি-বাদনে।
শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের নামে যা
তিনি করেছেন, তার বাস্তবতা
হয় যদি এতটা করুণ ও ভয়াবহ,
তাহলে প্রবন্ধের নামে
মননশীল সাহিত্যভাণ্ডারে যা
কিছু উগলিয়েছেন, তা না
জানি কতটা অস্পৃশ্য ও
যন্ত্রণাকর। অবশ্য এগুলো কি
প্রবন্ধ হওয়ার মতো যোগ্য ও
উপাদেয় লেখা? নিছক
আর্টিকেলকে, পত্রিকায়
প্রকাশের নিমিত্তে লেখা দুই-
তিন স্লিপ কিংবা তার
কমবেশি লেখাকে চালিয়ে
দেয়া হয়েছে প্রবন্ধ বলে।
পত্রিকায় প্রকাশিত আর্টিকেল
কি প্রবন্ধ? নাকি আল
মাহমুদের ভাষায় এগুলো শুধু
প্রবন্ধ না শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ হওয়ার
উষ্ণীষ প্রাপ্তি দাবিদার?
তাই তিনি ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’র
লেবেল সেঁটে দিয়েছেন
দ্বিধাহীনতায়-
নিঃশঙ্কচিত্তে। অথচ প্রায়
প্রতিটি প্রবন্ধতেই তিনি
শুনিয়েছেন খাঁজকাটা কুমিরের
গল্প। যা কিছু দিয়েই শুরু করুন
না কেন, শেষাবধি তিনি
নিজের অভিসন্ধিকেই উগলে
দিয়েছেন পাঠক সমীপে।
কোনো প্রবন্ধেই নতুন তো দূরে
থাকে, পুরনো কোনো মাত্রার
বিশ্লেষণ নেই, নেই কোনো
ব্যাখ্যা যুক্ত করার তাগিদ,
নেই নতুন কোনো তথ্য-উপাত্ত
মেলে ধরার প্রয়াস ও
প্রচেষ্টা।
শুধু রয়েছে সিদ্ধান্ত। অবশ্য
সিদ্ধান্তেরও বালাই নয়, প্রবল
ও যুক্তিসিদ্ধ। আছে শুধু সূচনা
আর উপসংহার। যাতে সবর্দাই
ক্রীড়নক থেকেছে তার ইজম,
অভীপ্সা ও অভিসন্ধি।
আল মাহমুদ ‘বঙ্কিম ও সুনীল’
প্রবন্ধে বঙ্কিমকে যেভাবে
শনাক্ত ও চিহ্নিত করেছেন,
তাতে যে কারো মনে হতে
পারে— বঙ্কিমের বাংলা
সাহিত্যে কোনো অবদান নেই,
শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প
উদগীরণ করা ছাড়া। যাকে
সাহিত্যসম্রাটের স্বীকৃতি ও
অভিধা দেয়া হয়েছে, তার এই
মূল্যায়ন (অবমূল্যায়ন) যুক্তিযুক্ত
কি? তার পরও এ প্রবন্ধে তার
এই উদ্দেশ্য হাসিলের পেছনে
কোনো সহায়ক কথাবার্তা,
আলাপ-আলোচনা, উদ্ধৃতি
কোনো কিছুই নেই। সুনীলের
পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসের যে
ফোকর তিনি আবিষ্কার
করেছেন, তাই-ই বা কতটা
যুক্তিযুক্ত। আল মাহমুদ
লিখেছেন, ‘তার রচনার (সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়) অবাস্তবতা ও
অসংলগ্নতার কারণেই একটি
সত্য মুক্তিযুদ্ধকেও অলীক
বানোয়াট কাহিনী বলেই মনে
হয়। মনে হয় বইটি (পূর্ব-পশ্চিম)
একজন অতিশয় চতুর হিন্দু
সাম্প্রদায়িকতাবাদীরই সুচতুর
রচনা। যিনি হিন্দু-মুসলমানের
মিলনপ্রয়াসের ছদ্মবেশের
নিচে ভারতীয় আধিপত্যবাদের
ষড়যন্ত্র জালটি সুকৌশলে
বিছিয়ে রেখেছেন।’ আদতে কি
তা-ই!
আধিপত্যবাদের কথা বলেন
আধিপত্যবাদের ভূতকে ঘাড়ে
রেখে। আধিপত্যবাদ মানে কি
শুধু ভারতীয় আধিপত্যবাদ,
ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ? আর
কোনো আধিপত্যবাদের দস্যুতা
কি নেই?
আধিপত্যবাদকে দলিত করে
স্বজাতি-স্বভূমের মানুষদের
ঐতিহ্যমথিত করে বিকশিত ও
চর্চিত করার সৃজন প্রয়াস কতটা
বিস্তার রেখেছেন আপনি
সোনালী কাবিনের কবি আল
মাহমুদ?
‘দিশেহারা কবির দল’ প্রবন্ধে
আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘এখন, এ
সময় কবিতা রচনা হলো একদল
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গ্রাম্য
বালকের এ শহরের চৌহদ্দিতে
নাগরিক বখাটেপনার সর্বশেষ
উপায় মাত্র।’
‘সমকালে রবীন্দ্র কাব্যের
উপযোগিতা’ প্রবন্ধে
চিত্তাকর্ষক দুটি লাইন আল
মাহমুদের স্ববিরোধিতাকেই
উন্মোচিত ও প্রকটিত করেছে।
তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্র-
কাব্যে আমি কি খুঁজি? খুঁজি
বিশ্বাসে বিনম্র হূদয়। এই
উপমহাদেশের প্রাচীন সমস্ত
গৌরবই লুকিয়ে আছে ধ্যানমগ্ন
অনুসন্ধানের ব্যাকুলতার মধ্যে।
সমগ্র উপনিষদ থেকে একজন কবি
যা আহরণ করেন, এর নাম দেওয়া
যায় আনন্দের আস্বাদন বলে।’
আল মাহমুদের শহীদুল্লাহ
মূল্যায়ন, বুদ্ধদেব বসু মূল্যায়নসহ
এমন অনেক প্রবন্ধের নামের
ধারাপাত উদ্ধৃতি হলে দেখা
যায়, সেখানে তিনি তার
ইজমকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সুতরাং সব মূল্যায়ন, সব
পরিভ্রমণ, সব রেখাপাত কবি
আল মাহমুদকে উহ্য করে যে
সত্তার আবির্ভাব ঘটায়, তিনি
‘ভুল’ বিকিকিনির ভুল মাহমুদ।
অবশ্য ইউটার্নপ্রিয় আল মাহমুদ
কামিয়াব হতে চেয়েছিলেন এই
রূপে-এই বিভ্রান্ত ছড়ানোর
সাধু (!) রসে ও রঙ্গমাতমে।
যিনি নিজেই সাম্প্রদায়িক,
আধিপত্যবাদের ঝাণ্ডাবাহী ও
মৌল চেতনায় নিবিষ্ট এবং
আস্থাবান, তিনিই যখন
আওয়াজ দেন এসবের উজান
স্রোতে দাঁড়িয়ে, তখন তা হয়ে
ওঠে সংশয়িত ও ভুল বার্তার
ইস্কাপন টেক্কা। তাই সৃজন-মনন
ভূমের আল মাহমুদ পাঠে ও
প্রীতিতে অধিক সতর্ক ও
সাবধানতা অবলম্বন জরুরি ও
অবশ্যম্ভাবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সূরায়ে ফাতিহা!

সূরা আল ফাতিহার বাংলা ও ইংরেজি অর্থ ইসলাম ডেস্ক: সূরা ফাতিহা (মক্কায় অবতীর্ণ), এর আয়াত সংখ্যা 7 ﺑِﺴْﻢِ ﺍﻟﻠّﻪِ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤـَﻦِ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴﻢ...