ছাত্রলীগ থেকে বিবাহিত নয়
অছাত্র-মাস্তানদের বের করুন
পীর হাবিবুর রহমান
ছাত্রলীগ থেকে
বিবাহিত নয়
অছাত্র-
মাস্তানদের বের
করুন
নির্বাচিত কলাম।
ছাত্রলীগের প্রতি আমার একটি
নিজস্ব দুর্বলতা রয়েছে।
ছাত্রলীগের প্রতি আমার
গভীর আবেগ, অনুভূতি রয়েছে।
বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ যখন
সমালোচনার তীরে ক্ষত-
বিক্ষত হয়, কিংবা আমি
নিজেও কখানো-সখনো
ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে
কঠিন সমালোচনা করি; মনে হয়
আমার বুকে আমি নিজেই ছুরি
চালাচ্ছি।
আমার অগ্রজ এ্যাডভোকেট
মতিউর রহমান পীর ১৯৭৫ সালে
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যখন
গোটা জাতির জীবনে এক
অন্ধকার সময় নেমে এসেছিল,
আওয়ামী লীগের ও
ছাত্রলীগের রাজনীতিতে
নেমেছিল কঠিন দমন নির্যাতন,
ঠিক তখন সুনামগঞ্জ জেলা
ছাত্রলীগকে পুর্নজন্ম এবং
সুসংগঠিত করার নেতৃত্ব
দিয়েছিলেন। সেই সময় কেন্দ্র
থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সারাদেশে
বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ বুকে
নিয়ে সকল ভয়, ভীতিকে
উপক্ষো করে আত্মসমালোচনা,
আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পথে
ত্যাগের মহিমায় ছাত্রলীগকে
নবযৌবন দিয়েছিলেন।
সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে
জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃত্ব যখন
কারারুদ্ধ কিংবা নির্বাসিত
তখন মতিউর রহমান পীর
সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের
আহ্বায়ক হয়েছিলেন ৭ জন সদস্য
নিয়ে ১৯৭৭ সালে। ১৯৭৮ সালের
সম্মেলনে প্রথম তিনি
সভাপতি নির্বাচিত
হয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের
সম্মেলনে হয়েছিলেন ২য় দফা
সভাপতি। সেই সময় শুধু
সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের
দুঃশাসনই তাদের পথরুদ্ধ করতে
চায়নি; অতিবিপ্লবী, উগ্র,
হঠকারী আওয়ামী লীগ ও মুজিব
বিদ্বেষী রাজনৈতিক শক্তিও
তাদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে
চেয়েছিল।
আদর্শিক রাজনীতি দিয়েই
সবাই মিলে একটা টিম
ওয়ার্কের মাধ্যমে খেয়ে না
খেয়ে অসাধারণ সাংগঠনিক
দক্ষতায় তারা ছাত্রলীগকে
শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত
করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ছাত্র
সংসদ নির্বাচনে ডাকসুতেই
ছাত্রলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা
পায়নি, সারাদেশেই বিজয়
পতাকা উড়িয়েছিল। সুনামগঞ্জ
সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ
নির্বাচনে প্রথম ছাত্রলীগ
১৯৭৯ সালে এজিএস আনোয়ার
চৌধুরী আনুর নেতৃত্বে
সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
ভিপি পদে নান্টু রায় ছাত্র
ইউনিয়ন প্রার্থীর সঙ্গে সমান
ভোট পেলে লটারিতে হেরে
যান। পরের বছর ভিপি, জিএস,
এজিএস সহ ছাত্রলীগ পূর্ণ
প্যানেলে বিজয়ী হয়।
সেই সময় আওয়ামী লীগ
নেতাদের সন্তান আর
ছাত্রলীগ নেতাদের ভাই-বোন
হিসাবে আমরা ছাত্রলীগের
মিছিলে যুক্ত হয়েছি। স্কুল
জীবন থেকে ছাত্রলীগের
রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত
হয়েছি। ছাত্রলীগের কেন্দ্র
থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাদের
কখনোই টেন্ডারবাজি,
চাঁদাবাজি কিংবা তদবির
বাণিজ্যে যুক্ত হতে দেখিনি।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে কেন্দ্র
থেকে তৃণমূলের নেতারা বাসে
ট্রেনে চড়েছেন, কর্মীদের
বাড়িতে থেকেছেন বা
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ
ছাত্রাবাসে রাত্রিযাপন করে
আদর্শের উন্মাদনা নিয়ে
সংগঠনকে শ্রম দিয়েছেন।
মেধা, প্রজ্ঞা, পড়াশুনায়,
বাগ্মিতায় নিয়মিত ছাত্রদের
সংগঠনে টেনেছেন। মেধাবী,
সৃজনশীল ছাত্রদের সংসদ
নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন।
সেই ছাত্র রাজনীতি দিনে
দিনে অসুস্থ ধারায় পতিত
হয়েছে। গণ রাজনীতিতে যুক্ত
রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ভোগ-
বিলাসের পথে হেঁটেছেন,
এমপি-মন্ত্রীরা যখন ছাত্র
সংগঠনের কর্মীদেরকে নিজস্ব
আধিপত্য বিস্তারের
রাজনীতি বাণিজ্যিকীকরণে
ব্যবহার করেছেন তখনই জাতীয়
রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র
রাজনীতি পথহারা হয়েছে।
অন্যদিকে, ২৬ বছর ধরে
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র
সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখায়
রাজনীতিতে আদর্শিক ইমেজ
সম্পন্ন, সমাজে প্রভাব
বিস্তার করা আলোকিত
নেতা-কর্মী যেমন সৃষ্টি হয়নি;
তেমনি আধিপত্যের লড়াইয়ে
যখন যে দল ক্ষমতায় তাদের
ছাত্র সংগঠন
শিক্ষাঙ্গনগুলোতে চর দখলের
মতো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
করেছে। একপক্ষ ক্ষমতায় এলে
তাদের সংগঠন প্রতিপক্ষ
ছাত্রসংগঠনকে ক্যাম্পাস
ছাড়া করেছে। শুধু তাই নয়,
জেলায় জেলায় অছাত্রদের
হাতে ছাত্র রাজনীতির কর্তৃত্ব
গেছে। ছাত্রদের আবাসন থেকে
নানান সমস্যা নিয়ে
শিক্ষাঙ্গন কেন্দ্রিক ছাত্র
রাজনীতির তৎপরতা বন্ধই
হয়নি, ছাত্রনেতারা প্রকৌশল
দপ্তর থেকে হাট, মাঠ, ঘাট
ইজারা-দখলে ব্যস্ত হয়েছেন।
কমিটি বাণিজ্য গণরাজনীতি
থেকে ছাত্র রাজনীতিতে
বিষক্রিয়ার মতো ছড়িয়েছে।
নানা সময়ে ছাত্রলীগ গত ৯
বছরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে
বিতর্কিত হয়েছে। নিজেরা
নিজেরা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার
দ্বন্দ্বে সংঘাতে জড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ছাত্রলীগের
ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস,
বাংলাদেশের ইতিহাস।
ছাত্রলীগের হাত ধরেই ৬২ এর
শিক্ষা আন্দোলন হয়েছে,
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা গণমানুষের
কাছে ছড়িয়েছে। ছাত্রলীগের
নেতৃত্বেই ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান,
৭০ এর ব্যালট বিপ্লব, সুমহান
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের
অভ্যুদ্ধয় ঘটেছে।
ছাত্রলীগের ওপর ভর করেই
জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান গোটা
জাতিকে স্বাধীকার-
স্বাধীনতার পথে এক মোহনায়
মিলিত করেছিলেন। প্রতিটি
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা
অগ্রভাগেই থাকেনি, পুলিশের
নির্যাতন ভোগ করেছে,
সামরিক শাসকদের দমন নীতি
ভোগ করেছে, আত্নাহুতি
দিয়েছে, কারারুদ্ধ হয়েছে।
ছাত্রলীগের সেই ঐতিহ্যের
উত্তরাধিকারিত্ব আজকের
ছাত্রলীগ ধারণ করছে কিনা?
বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শিক পথে
হাঁটছে কিনা? এই প্রশ্ন উঠছে।
এই প্রশ্ন তোলার আগে,
গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ
করার যে দিকটি রয়েছে সেটি
হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে
যুক্ত বা গণসংগঠনে যুক্ত
নেতারা বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ
মানবকল্যাণের গণমূখী
দেশপ্রেমের আদর্শিক
রাজনীতি বহন করছেন কিনা?
ক্যান্সার যখন ছড়ায়, শরীরের
সর্বত্র ছড়ায়। তেমনি জাতীয়
রাজনীতির ক্যান্সার ছাত্র
রাজনীতিতে যেখানে ছড়িয়ে
সেখানে ছাত্রলীগ ধোয়া
তুলসী পাতার মতো থাকবে-
এমনটি আশা করা যায় না।
জাতীয় রাজনীতিতে আদর্শের
পতাকা উজ্জীবিত হলে,
সততার রাজনীতি পুনর্বাসিত
হলে বঙ্গবন্ধুর নিরাবরণ,
সাদামাটা, ত্যাগের নির্লোভ
রাজনীতি লালন করলে
ছাত্রলীগের রাজনীতিও
কলংকমুক্ত হবে। আয়নায়
নিজেদের চেহারা না দেখে
ছাত্রলীগকে শাসন করলে সেটি
কার্যকর হবে না।
৯০ এর ছাত্র আন্দোলনেও
ছাত্রলীগ ঐতিহাসিক নেতৃত্ব
দিয়েছে। বলা হয়, তোফায়েল
আহমেদের পর ডাকসু বিজয়ী
সুলতান মুহাম্মদ মনসুর
আহমেদের পর কোনো নেতৃত্ব
বেরিয়ে আসেনি। কিন্তু অনেক
নেতৃত্বই বেরিয়ে আসতে
পারতো, যদি ৯০-এর পর
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ
ছাত্রসংসদ নির্বাচন অব্যাহত
থাকতো।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি
এনামুল হক শামীমের মতো
কর্মীবান্ধব, মাইনুদ্দিন হাসান
চৌধুরী, বাহদুর বেপারী,
ইকবালুর রহিম, অজয় কর খোকন,
মারুফা আক্তার পপি, মাহমুদ
হাসান রিপন, মাহমুদুল হাসান
রোটন, বদিউজ্জামান
সোহাগের মতো নেতৃত্ব
বেরিয়ে এসেছে। এরা যদি
ডাকসু নির্বাচনে অভিষিক্ত
হতে পারতো তাহলে জাতীয়
রাজনীতিতে আলোকিত
ভূমিকা রাখতে পারতো।
এনামুল হক শামীম জাকসু ভিপি
নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।
বর্তমান ছাত্রলীগকে সভাপতি
এম সাইফুর রহমান সোহাগ ও
সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির
হোসাইন নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
দেশের বিভিন্ন জায়গায়
ছাত্রলীগের নেতারা গাড়ি-
বাড়ির মালিক হচ্ছেন। ব্যবসা-
বাণিজ্যে জড়িয়েছেন।
তারপরেও এই নেতৃত্ব অনেক
জায়গায় সংগঠন বিরোধী
কর্মকাণ্ডে যেখানে যে জড়িত
হয়েছেন, সেখানেই সাংগঠনিক
ব্যবস্থা নিয়েছেন। মানবিক
ছাত্র রাজনীতির বাইরেও
প্রশংসিত অনেক মানবিক
উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রাকৃতিক
বিপর্যয়ে মানুষের পাশে
দাঁড়িয়েছেন। অনাথের পাশেও
তাদের দাঁড়াতে দেখা গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়,
সাংগঠিক সফরে ছাত্রলীগের
নেতারা কিভাবে প্রাইভেট
হেলিকপ্টারে, বিমানে সফর
করেন? তাদের জন্য প্রাডো
থেকে পাজেরো কেমন করে
তৈরি থাকে? তারা তো
পকেটের পয়সায় এই ব্যয় নির্বাহ
করার কথা নয়। এই ব্যয় ও সুযোগ
সুবিধার দুয়ার গণসংগঠনের
সেইসব হাইব্রিড বা রাজনীতি
বাণিজ্যিকীকরণের সঙ্গে যুক্ত
নেতৃত্বই আয়োজন করেন। এই
ভোগ-বিলাসের পথে
ছাত্রলীগের নেতৃত্বকে যারা
টানেন, ছাত্রলীগের মুরুব্বি
সংগঠন আওয়ামী লীগের
নেতারা কি একবার চিন্তা
করেছেন বা ব্যবস্থা নিয়েছেন?
ছাত্রলীগের সাধারণ সভায়
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন,
ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ
সম্পাদকের বিরুদ্ধে। কেউ
নাকি ৫৫ হাজার টাকার
ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। কেউ
কেউ বিত্ত-বৈভবের মালিকও
নাকি হয়েছেন। আমার
অনুজপ্রতীম ছাত্রলীগ সভাপতি
সাইফুর রহমান সোহাগ ও
সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির
হোসাইনের কাছে অনুরোধ
তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত
পড়ে আছে। জাতীয়
রাজনীতিতেও তারা ভূমিকা
রাখবেন। অতএব যে প্রশ্ন
উঠেছে তার ব্যাখ্যা সংবাদ
সম্মেলনের মাধ্যমে তারা
নিজেরাই দেবেন।
তাদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত
অভিযোগ নেই। শুধু এই অনুরোধটুকু
রাখছি, বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ,
চিন্তা-চেতনা, জীবন-যাপনের
মহান দিকগুলো লালন করার মধ্য
দিয়ে ছাত্রলীগের
নেতাকর্মীদেরও সেই পথ নিয়ে
মানুষের কল্যাণের রাজনীতি
পাঠ দিতে। ছাত্রলীগের সভায়
আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে
বিবাহিতরা ৭২ ঘন্টার মধ্যে
পদত্যাগ করবেন। এটা কোনো
যুক্তি হতে পারে না। নিয়মিত
ছাত্ররাই গঠনতান্ত্রিকভাবে
ছাত্রলীগের সদস্য হতে
পারেন। ছাত্রলীগের নির্দেশ
হতে পারতো অছাত্র,
সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের
পদত্যাগ করার আহ্বান
জানানোর। আমাদের অনুরোধ
ছাত্রজীবনে অনেকেই প্রণয়ের
পাঠ নিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ
হন। সেই বিবাহিতদের নয়,
অছাত্র, সন্ত্রাসী ও
চাঁদাবাজদের দল থেকে সরিয়ে
দিন এবং ডাকসুসহ সকল
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র
সংসদ নির্বাচন আদায় করুন।
পীর হাবিবুর রহমান
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন