প্রজন্ম চতুষ্কোণ, যাচ্ছে কোথায়?
কিন্তু মেয়েটার মন খারাপ সম্পূর্ণ অন্য কারণে। যেটা অনেকটা অস্বাভাবিক। মেয়েটার ভাষায় ‘বলা যাবেনা’ কারণটা এমন টাইপ। যদিও ও বলে বলা যাবে না। কিন্তু আমার ‘বয়স’ বোঝে। অতঃপর বেরিয়ে আসে মূল ঘটনা। কয়েকদিন আগে মানে গত বর্ষার শেষে ‘বন্ধুরা’ মিলে গিয়েছিল আশুলিয়া। বন্ধু মানে যে এক সঙ্গে পড়ে, তা কিন্তু নয়। সোশ্যাল মিডিয়া সুযোগ দিয়েছে যে কাউকে বন্ধু ডাকার।
অতএব নানা পরিবেশের বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে। ঘোরাঘুরি। টং দোকানে চা। অতঃপর নৌকাভ্রমণ। ছইওয়ালা, পর্দা টানা। এক ঘণ্টার রাইড। সবাই মিলে এক নৌকায় কি হলো যদিও ওর ভাষাতেই ‘বলা যাবে না’। কিন্তু ওর সত্য কনফেশন, ‘তখন খারাপ লাগেনি’। এর পর আরো কয়েকবার, অন্য কোথাও।
কখনো বাসায় জানলো স্টাডি ট্যুরে যেতে হচ্ছে। রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার বাবা পেনশনের টাকা থেকে বাড়তি টাকা পাঠান। কখনো জানলো বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যাচ্ছে। মফস্বল কলেজের শিক্ষক বড় ভাই এক মাস টিউশনি করে পাওয়া টাকার পুরোটাই পাঠায়। আবার কখনো জানলোই না। তাহলে ৬ মাস পরে এখন হঠাৎ মন খারাপটা এলো কোথা থেকে? কারণ একটা ভুল হয়েছে মস্ত। যার দায়ভার এখন শুধুই তার।
কারণ ছেলেটাতো তার ‘বন্ধু’ ছিল। বয়ফ্রেন্ড ছিল না। ওরতো মেয়েটার প্রতি কোন ভালোবাসা ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা ছেলেটাতো একা ছিল না। সবাই মিলে ‘ফান’ করেছে, দায় কেন কেউ একলা নেবে?
সুতরাং সমস্ত বিপদ বা যদি বলি ডেকে আনা আপদ কিন্তু এখন মেয়েটার। মেয়েটা মাথা চাপড়ায় আর বলে ওর চেনাশোনা অন্যদের কথা। অমুকতো এটা করলো তমুকতো ওটা করলো ওদের তো কিছু হলো না। মেয়েটার আহাজারি শুনি আর আমার চোখ কপালে ওঠে। বলে কি এই মেয়ে! জেনারেশনের এই অবস্থা! বন্ধু শব্দটার এই মূল্যায়ণ!
মেয়েটা কিন্তু আমার বন্ধুর বোন। যে সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্বের। স্কুল জীবন থেকে চেনা এই বন্ধুর প্রথম সিগারেট আমার চোখের সামনে। প্রথম প্রেমে পড়া, প্রেমিকার জন্য প্রথম গিফট কেনা, প্রথম প্রেম ভেঙ্গে যাওয়া সবই আমার সামনে। চাকুরির ইন্টারভিউ, বিসিএসের ফর্ম ফিলাপ আমার পাশে বসে। জীবনের কোন বিষয়টা নেই আমাদের আলোচনা হয় না। সম্পর্কটা শুধু দু’জন মানুষের না, সম্পর্কটা চলে গেছে দুই পরিবারে। তারই সূত্র ধরে ছোট বোনের কিছু একটা হয়েছে জেনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ।
বন্ধু বলতে আমরা অন্ততঃ আমাদের জেনারেশন এমন একটা সম্পর্কের কথাই ভাবতাম। আমাদের লাইফে স্ট্রাগল ছিল। পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলো আমরা বুঝতাম। আবার বুঝতাম প্রত্যাশার দিকগুলোও। আমরাও ভালোবাসতাম। ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের মধ্যে তফাৎ ছিল। আমাদের মধ্যেই যারা কোন বন্ধুকে ভালোবাসতো, সবাই জানতাম, বুঝতাম, দে আর ফর দেমসেলভ। আমাদের বন্ধুরা বন্ধুই থাকতো। এখনকার জেনারেশনের একটা অংশ দেখি ভালোবাসে না। তারা লাভ মেক করে। এবং তা যার তার সঙ্গে, যত্রতত্র, যেখানে সেখানে।
তুলনামূলক আমি আগের প্রজন্ম, তার উপর বাংলা মিডিয়াম, পাবলিক ইউনিভার্সিটি। সেদিন কথা বলছিলাম পরের প্রজন্ম, ইংলিশ মিডিয়াম, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজনের সঙ্গে। বিষয আদি ও অকৃত্রিম ‘প্রেম’। প্রেম কীরকম, কীভাবে হয়, কী করে ইত্যাদি, ইত্যাদি। কাকে বলে ডেট করা, কাকে বলে গো আউট, অ্যাফেয়ার আর রিলেশনের তফাৎ কী, এক্সপ্লোরিং আর কমিটেড মানে কী বোঝায, এ যুগের ওপেন ম্যারেজ কী। সংজ্ঞাসহ প্রায় সব কিছুই আমার মস্তিষ্কে ঢোকানোর চেষ্টা চলে ঘণ্টাখানেক।
বয়স ২৫ এর কম, কিন্তু বন্ধুমহলে কেন এত ডিভোর্সীর সংখ্যা সেই নিয়েও চলে কিছু চিন্তাভাবনা। আলোচনার শেষ যখন হয, আমার মাথার মধ্যে ভীড় করে হাজারও প্রশ্ন। এই যদি হয় প্রজন্মের প্রেমের সংজ্ঞা তাহলে অস্থিরতা কাকে বলে?
সন্দেহ নাই তুলনামূলক বেশি মেধাবী এই প্রজন্ম। একই সঙ্গে সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত প্রজন্ম। এই সময়ে এসে যতবার আমি গুগলে ব্রাউজ করি। ততবার আমার নিজের ইউনিভার্সিটি লাইফের কথা মনে পড়ে। পড়তাম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে। প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক পরিবর্তনগুলোর খোঁজ খবর, বিশ্লেষণ জানতে হতো। অথচ তথ্য প্রাপ্তির কি অপর্যাপ্ত সুবিধা। মাত্র এক যুগে পাল্টে গেছে চিত্র। কত সহজেই বিশ্ব হাতের মুঠোয়।
সুতরাং নতুন প্রজন্মের কি সুযোগ! প্রশ্নটা এখানেই। এই সুযোগটা কাজের কাজে ব্যবহার করার হার কতটা। আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে অনেক তরুণ, এটা সত্যি। গুগল বা মাইক্রোসফটে কাজ পাচ্ছে আমাদেরই তরুণ প্রজন্ম। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে সমাজ সেবা করছে, সামাজিক উন্নয়ন করছে অনেক মেধাবী তরুণ। ই কমার্সে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণরাই। আবার পর্ণোসাইট ব্রাউজ করায় যে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম ৫টি দেশের একটি সেটাও কিন্তু প্রজন্মেরই একটা অংশের অবদান।
এ সময়ে পঁচিশের নিচে যাদের বয়স তাদের সঙ্গে কথা বললে অবাক হই। প্রতি ৫ জনে ৩ জন দেখা যায় দেশটাকে জানে না। প্রাইভেট বা পাবলিক যেই প্রতিষ্ঠানই হোক, ইংরেজি বা বাংলা যেই মাধ্যমই হোক। জানে না মানে ইতিহাস জানে না। সংস্কৃতি বোঝে না। সাহিত্যতো আরো দূরের। সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন শেকড় থেকে দূরে থাকা প্রজন্ম। প্রতি পাঁচ বছরে এদেশের ইতিহাস বদল হয়, কথা সত্যি।
কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠা ছাড়াও দেশের কিছু গল্প আছে, ছিল, প্রায় প্রতিটি পরিবারে। সেই গল্প তারা কোন দিন শোনেনি। আবার কোন কিছুতে উস্কে দিলে এরা উস্কায়। স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। ভালো মন্দের তফাৎ না বুঝেই। পীয়ার প্রেসারে এরাই এক্সট্রিমিস্ট হয়ে যায়। রাজনৈতিক উগ্রতা বলি বা ধর্মীয় উগ্রপন্থা, খুব সহজে দখল নিতে পারে এদের মস্তিষ্ক। যেমনটা দেখেছি হলি আর্টিজান এবং তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে।
দেশের শেকড় দূরে থাক, এরা পরিবারের শেকড়েরও খবর রাখে না। গণতন্ত্রায়ন বা মুক্ত বাজার অর্থনীতি যেটাই বলি ৯০ এর পরে তা এদেশে উঠতি উচ্চবিত্ত শ্রেণী তৈরি করেছে। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী। প্রথম প্রজন্ম লেখাপড়া শিখছে, শহরমুখী হচ্ছে। এক ক্লিকে দেশ বিদেশের ছবি দেখছে, ফুটফাট ইংরেজী বলছে। অল্প শিক্ষিত, কষ্ট করে দিনাতিপাত করা মা বাবা তাতেই মুগ্ধ। ভাবছে ছেলে মেয়ে অনেক বোঝে, আমরা ব্যাকডেটেড।সুতরাং, সন্তানরা লাগামছাড়া। মূল্যবোধ নামের একটা শব্দ তাদের ডিকশনারী থেকে পুরোপুরি উধাও।
সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে একটা চতুষ্কোণ প্রজন্ম। যারা না ঘরকা, না ঘাটকা। কী করছে, কেন করছে, কী এর ফলাফল কোন ভাবনা নেই। কোন কিছুর প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। লাইফ এদের কাছে ফান। তো ফান করতে গিয়ে কোন গহব্বরে চলে যাচ্ছে জীবন, কোন মাথা ব্যথা নেই। চর্ম মাংসে যে অনুভূতি। যে অনুভূতি পশুরও আছে সেটাই যেন সবকিছু।
এর বাইরের মানবিক পৃথিবীটা ওরা দেখে ওদের চশমায়। চারিদিকে এমনিতেই আমাদের অনেক আতঙ্ক, অনেক অশনি। ভয় হয় সুযোগের অপব্যবহার করা চতুষ্কোণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের অতি আধুনিকতা, অধঃগামীতা সামনে কোন দুঃসময় না জানি ডেকে আনে।
শেগুফতা শারমিন : কলাম লেখক, উন্নয়নকর্মী।
shegufta@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন