ঈদ বানানে সমস্যা কোথায়?
—অধ্যাপক ড: মনসুর মুসা
ঈদের ঈ-কে ই করার কোনো মানে হয়
না।
চিরকালের ঈদের বানান বদলানোর
প্রশ্ন
তোলার আর সময় পাওয়া গেল না!
আর
কিছু না পারলে বানান বদলানো হয়।
লিখিত ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার
অভাব
থেকেই এমনটা করা হয় বলে দেখি।
ঈদকে
দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে আবহমানকাল থেকেই
লেখা হচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা হয়
‘Eid’। E-এর পর ওই I-টা লেখা হয়
দীর্ঘ
‘ঈ’ স্বর বোঝানোর জন্যই। আমি যদি
কারও নাম বদলাই, তা ভুল। এতে তার
প্রতি অসম্মান প্রকাশ করা হয়। ঈদ
তো
একটা উৎসবের নাম। নাম ও
ট্রেডমার্ক
ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক নয়। এটা
হলো
কর্তৃত্বের প্রশ্ন। আজাদ পত্রিকা ৫০
বছর
চেষ্টা করেছে ইকবালকে একবাল,
ইসলামকে এসলাম লিখতে। টেকেনি।
ভাষা বেশি ইডিওসিনক্রেসি বা
মতাচ্ছন্নতা পছন্দ করে না।
ভাষার মুখ্য কথ্য ও লিখিত রূপের
মধ্যে
লিখিত রূপই ভাষাকে স্থায়িত্ব
দেয়।
লিখিত রূপকে বারবার বদলালে
ভাষার
শব্দের বিকল্পের মাত্রা বেড়ে
যাবে।
কিছু কিছু জায়গায় বিকল্প থাকতে
পারে,
তবে সেটা ভাষা পরিকল্পনার অংশ
হিসেবে আসতে হবে। হুটহাট বানান
বদলালে সময় ও খরচ বেড়ে যাবে;
অর্থ
বদলে যেতে থাকবে। এতে করে
ভাষায়
বিশৃঙ্খলাও বাড়ানো হবে। এত
বিকল্প
থাকা শিশুদের জন্য ভালো নয়।
একেক
কিছু পড়তে গিয়ে একেক বানান দেখে
তারা বিভ্রান্ত হয়। তখন তাদের
কাছে
ইংরেজিকেই সহজ ভাষা মনে হয়।
অথচ
বাংলার রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম
শৃঙ্খলাবদ্ধ সুন্দর বর্ণমালা। আগে
এতে
অন্ত্যস্থ ব ও বর্গীয় ব হিসেবে দুটি
বর্ণ
ছিল। অন্ত্যস্থ ব হলো ইংরেজি
ডব্লিউ,
বর্গীয় ব হলো বি। আমরা পার্থক্য না
বুঝে
একটা ফেলে দিয়েছি।
এ সমস্যাটি আমি আমার ‘বানান:
বাংলা বর্ণমালা পরিচয় ও
প্রতিবর্ণীকরণ’ বইটিতে বিস্তর
আলোচনা রেখেছি। বাংলা
বানানবিষয়ক আলোচনার গোড়ায়
একটি
তাত্ত্বিক সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে
আসছে। বাংলা ভাষায় শব্দের
জাতবিচার সম্পর্কিত তাত্ত্বিক
সমস্যাই
বাংলা বানানের নিয়মের ক্ষেত্রে
প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
প্রথাগতভাবে বাংলা শব্দকে
পণ্ডিতেরা ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে
তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি-এই
চার
শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। কেউ
কেউ
আরও একটি বর্গ বৃদ্ধি করেছেন, তার
নাম
দিয়েছেন অর্ধ-তৎসম। এই বিভাজনের
ভেতরে ভাষা-সংগঠনগত সৌসাদৃশ্য
কতটা কাজ করে, তা সচরাচর তলিয়ে
দেখা হয় না। তদুপরি, অনেক শব্দ
আছে,
যেগুলোকে প্রথাগত চতুর্বর্গ কিংবা
পঞ্চবর্গের আওতায় আনা যায় না।
মনে
করা যাক: ইংরেজী ভাষায় ইংরেজী
শব্দটি নেই, আছে ইংলিশ। শব্দটি
তৎসম
নয়, তদ্ভবও নয়, বিদেশি তো নয়ই,
একেবারে বাংলা। এটা তো বিদেশি
নয়,
তাহলে এর দীর্ঘ ঈ-কার লোপ করে ই
করা
কেন?
ঠিক তেমনি ফরাসি শব্দটি কোন
ভাষার
শব্দ? এটাও তো বাংলা শব্দ। এ
ধরনের
অনেক শব্দের জাত-বিচারের
ক্ষেত্রে
অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। অ-তৎসম বলে
কোনো একক বর্গ নেই। ফলে তৎসম ও
অ-
তৎসম দ্বিভাজন ব্যবহার করে যে
বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করা
হয়েছে,
তা বিধান হিসেবে সঠিক হয়নি।
বাংলা একাডেমির বানানের নিয়মে
এই
ভ্রান্তি আছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বানানেও এই ভুল
আছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
আকাদেমির
বানানেও আছে, কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানের নিয়মে
তো
ছিলই।
আরও একটি সমস্যা বানান-সমস্যার
সঙ্গে
জড়িত, তা হচ্ছে প্রতিবর্ণীকরণের
সমস্যা। ব্যাপারটি হচ্ছে বিদেশি
শব্দের
বানান বাংলা বর্ণ দিয়ে করতে
গিয়ে
কোন নীতি মানা হবে তা
সুনির্ধারিত
নয়। প্রতিবর্ণীকরণের সঙ্গে বানান-
বিধিকে গুলিয়ে ফেলে নতুন সমস্যার
সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈদ ও নবী বলব না
ইদ ও
নবি বলব, সুপ্রীম কোর্ট বলব না
সুপ্রিম
কোর্ট বলব-এ সমস্যার জন্ম সেখানেই।
এসব ক্ষেত্রে ভাষা-ব্যবহার আর
বানান
সমতাকরণ কিংবা ভাষার বানানের
নিয়ম তৈরি করার মধ্যে যে পার্থক্য
আছে, তা অনেকেই মানতে চান না।
বিদেশি ভাষার শব্দের বানানে
দীর্ঘ ঈ-
কার থাকবে না বলা হয়েছে। এই
মাপকাঠিটা পরিত্যাজ্য। ১৯ শতক বা
১৮
শতকে ইংরেজরা বিদেশি শব্দ বলতে
বোঝাত ফারসি ও ইংরেজিকে।
ইংরেজরা বলেছিল সংস্কৃত আলাদা
ভাষা। আলাদা বটে, কিন্তু তা তো
ইংরেজির মতো বিদেশি না। সে
আমলের তিন-চারটি বিদেশি
ভাষার
জায়গায় এখন তো আমাদের সামনে
রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের
ভাষা। এখন
সংস্কৃত-আরবি-ফারসি-ইংরেজির
অনেক শব্দই বাংলা ভাষার
শব্দভান্ডারের নিজস্ব সম্পদ হয়ে
গেছে।
সুতরাং বাঙালির মুখ দিয়ে যা বের
হয়,
তা-ই বাংলা বলে মানতে হবে। এর
মধ্যে
সংস্কৃত নেই, বিদেশি বলেও কিছু
নেই।
দেশি বা বিদেশি তো রাষ্ট্র দিয়ে
ঠিক
হয়, রাজনীতি দিয়ে চিহ্নিত হয়।
এটা
রাজনৈতিক ক্যাটাগরি। বিদেশে
গেলে
আমাদের পাসপোর্ট নিতে হয়।
তাহলে
পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলা ব্যবহৃত হয়,
তাকেও তো বিদেশি বলতে হয়।
বিদেশি
শব্দ যেকোনো ভাষা থেকে আসতে
পারে। না জেনে কোনো ভাষাকে
বিদেশি বলে দেওয়া ঠিক নয়। এসব
আসলে
লিখিত ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার
অভাব। ভাষার মধ্যে ইতিহাস ও
ঐতিহ্যের চিহ্নগুলো রক্ষা করাই
আমার
কাজ। দেশে যখন বানান-বাণিজ্য
প্রবল
হয়েছে, তখন আমি রক্ষণশীল। এটা
রক্ষণশীল বনাম ভক্ষণশীলের দ্বন্দ্ব।
লেখক: বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী,
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত
অধ্যাপক ও
বাংলা একাডেমির সাবেক
মহাপরিচালক।
মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০১৭
ঈদ বানানে সমস্যা কোথায়?
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
সূরায়ে ফাতিহা!
সূরা আল ফাতিহার বাংলা ও ইংরেজি অর্থ ইসলাম ডেস্ক: সূরা ফাতিহা (মক্কায় অবতীর্ণ), এর আয়াত সংখ্যা 7 ﺑِﺴْﻢِ ﺍﻟﻠّﻪِ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤـَﻦِ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴﻢ...

-
রাষ্ট্রদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহী ফরহাদ মজহার জুলাই ১৮, ২০১৭ 41 সম্পাদনা: মিয়া মোহাম্মদ হেলাল ফরহাদ মজহার ১৯৭২ সাথে কবি হুমায়ুন কবীর হত্যাকা...
-
রাকিব হাসান: রমজান শেষ। চলছে শাওয়াল মাস। কওমি মাদরাসার ছাত্রদের জন্য শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষা বর্ষ। মাদরাসার নিয়মানুসারে প্রতিবছর শাওয়াল ম...
-
ঈদ বার্তা: পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে প্রিয় বালাগঞ্জ ওসমানীনগর ও সিলেটবাসী, প্রবাসীসহ আওয়ামী পরিবারের নেতা কর্মীদের জানাই ঈদের শুভেচ্ছা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন