স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে
পরিচারিকার ঘরে
শুতে আসে সৌদি
গৃহকর্তা
তসলিমা নাসরিন
ছোটবেলায় মা আমাকে তার
স্বপ্নগুলো বলতো। মা’র স্বপ্নের
মধ্যে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল একবার
স্বচক্ষে সৌদি আরব দেখা।
পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র দেশ, মা
মনে করতো সৌদি আরব।
ওই দেশে জন্মেছেন আল্লাহর প্রিয়
নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)। ওই দেশে
ইসলাম ধর্মের জন্ম। ওই দেশের
ভাষা কোরআনের ভাষা। ওই দেশে
কাবা শরিফ, রওজা শরিফ। মা
মক্কা-মদিনার কথা বলতে বলতে
আবেগে কাঁদতো। ওই পবিত্র
দেশটির, ছোটবেলায় আমার মনে
হতো, সব নিখুঁত; কোনও ভুল নেই,
কোনও ত্রুটি নেই।
যত বড় হচ্ছিলাম, যত চারদিক
দেখছিলাম, পৃথিবীটাকে
জানছিলাম, মা’র স্বপ্নের ওই
দেশটি সম্পর্কে আমার মধুর মধুর
ধারণাগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে
পড়ছিল। সৌদি আরবে গণতন্ত্র নেই,
আছে রাজতন্ত্র। রাজ পরিবার
দেশটিকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই
করবে, কারও বাধা দেওয়ার
অধিকার নেই। দেশটিতে
মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, নারীর
অধিকার বলতে প্রায় কিছুই নেই।
পাবলিক প্লেসে টেনে নিয়ে গিয়ে
পাবলিককে দেখিয়ে তরবারির এক
কোপে অভিযুক্তদের মুণ্ডু কেটে
ফেলে সরকারি জল্লাদেরা। মুণ্ডুটা
রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক
পাশে ফুটবলের মতো গড়িয়ে চলে
যায়। উচ্ছাসে ফেটে পড়ে পাবলিক।
এই বীভৎসতা দেখা যায় না। সৌদি
আরবে বাক স্বাধীনতা নেই, মত
প্রকাশের স্বাধীনতা তো নেইই।
সৌদি মুক্তচিন্তক রাউফ
বাদাবিকে আজও জেলে ভরে রাখা
হয়েছে।
পুরুষগুলোর যত খুশি উপপত্নী।
মেয়েদের কপালে দুটো চুল এসে
পড়লে ধর্ম পুলিশ দোররা মারবে।
মেয়েরা গাড়ি চালাতে পারবে
না। মেয়েরা প্রতিবাদ করতে
পারবে না। মেয়েরা ধর্ষণের
শিকার হলে মেয়েদেরই শাস্তি
দেওয়া হবে। কোনও অমুসলমানের
মক্কা আর মদিনায় যাওয়ার
অধিকার নেই। অধিকার নেই সৌদি
নাগরিকত্ব পাওয়ার, অধিকার নেই
গির্জা মন্দির গড়ার।
এই সৌদি আরবের তেলের খনিতে
পঞ্চাশ- ষাট দশকে একসময় সৌদি
শ্রমিকেরা কাজ করতো। তারপর
এলো প্রতিবেশি আরব দেশ থেকে
শ্রমিক, তাও এক সময় বন্ধ হলো।
আশির দশকের শুরু থেকে শুরু হলো
এশিয়া থেকে শ্রমিক নেওয়া। এই
শ্রমিকেরা শ্রমিক হিসেবে তো
নয়ই, মানুষ হিসেবেও সামান্য
মর্যাদা পায় না সৌদি আরবে।
নারী শ্রমিকেরা যৌন হেনস্থা,
শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার,
আরও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
শ্রমিকের অধিকার আর
নিরাপত্তার তো প্রশ্ন ওঠে না।
কী করে সৌদি পুরুষেরা
গৃহকর্মীদের পেটায়, কী করে যৌন
নির্যাতন করে— সেসবের চিত্র গুগল
আর ইউটিউব ঘাঁটলেই মেলে।
বাংলাদেশের মেয়েরা যৌন
নির্যাতনের শিকার এত বেশি
হয়েছে যে আর আরবমুখো হতে চায়
না। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন,
শ্রীলঙ্কার মেয়েদের আর সৌদি
আরবে শ্রমিক হিসেবে পাঠানো
হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশের
মেয়েদের নেওয়ার জন্য সমন
পাঠিয়েছে সৌদি আরব। তারা
মেয়ে-শ্রমিক চাইছে। মেয়ে-
শ্রমিক না বলে আসলে ওদের
ক্রীতদাসী বলা উচিত। সৌদি
পুরুষেরা অত্যাচারী প্রভুর মতোই
আচরণ করে গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে।
সেদিনও একটি ভিডিওতে দেখলাম
এক বাঙালি মেয়েকে জনসমক্ষে
পিটিয়ে চ্যাংদোলা করে এক
দশাসই সৌদি পুরুষ তার গাড়িতে
ওঠালো। মেয়েটি দুজন বাঙালি
পুরুষের কাছে কাঁদছিল যেন তাকে
বাঁচায়। না, কেউ তাকে বাঁচাতে
চেষ্টা করেনি। বরং সৌদি
পুরুষটিকেই সাহায্য করেছে
মেয়েটিকে গায়ের জোরে
গাড়িতে ওঠানোর জন্য। পুরুষ-
শ্রমিকেরাও মেয়ে-শ্রমিকের পক্ষ
না নিয়ে পুরুষ-মালিকের পক্ষ নেয়।
শ্রেণির চেয়েও হয়তো বড় হয়ে ওঠে
লিঙ্গ!
অদ্ভুত একটা দেশ বটে। শ্রমিকদের
কাজ করিয়ে টাকা পয়সা না
দিলেও সৌদি নাগরিকদের কোনও
শাস্তি হয় না। ধর্ষণ করলেও হয় না,
নির্যাতন করলেও না। মালিকদের
কোনও আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন
মানতে হয় না, যত খুশি বর্বর হওয়ার
অধিকার তাদের আছে। শ্রমিকেরা
বন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে নিজ
দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য অস্থির
হয়ে ওঠে, কিন্তু অনেক সময় খাঁচা
থেকে বেরোনোর বা শেকল ছেঁড়ার
কোনও ক্ষমতা তাদের থাকে না।
সৌদি আইন শ্রমিকের পক্ষে যায়
না, অত্যাচারিতা, ধর্ষিতাদের
পক্ষে যায় না। সৌদি আইন থাকে
পুরুষের পক্ষে, ধনীর, শাসকের,
মালিকের পক্ষে।
সৌদি আরব দু-লক্ষ শ্রমিক চেয়েছে
বাংলাদেশের কাছে। বাংলাদেশ
থেকে মাসে দশ হাজার মেয়ে-
শ্রমিক সৌদি আরবে পাঠানোর
আয়োজন চলছে। সৌদি আরবে কোনও
নিরাপত্তা মেয়েদের নেই। সৌদি
মেয়েরাই নিরাপত্তা পায় না,
শ্রমিক মেয়েরা কী করে পাবে!
মেয়ে-শ্রমিকেরা কয়েক মাস পর পর
দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে,
কেউ কেউ গর্ভবতী হয়ে ফিরে
আসছে।
সামান্য টাকা পয়সার জন্য
জলজ্যান্ত নরকে মেয়েদের আর
পাঠানোর চেষ্টা না করাই ভালো।
সৌদি পুরুষেরা যখন গৃহশ্রমিকদের
মারে, মারে পা দিয়ে, পায়ের
জুতো দিয়ে, চাবুক দিয়ে। ভেবে
অবাক হই, মুসলমানেরা মুসলমানের
দেশে পরাধীন, অথচ খ্রিস্টান-
নাস্তিকদের দেশে তারা তুলনায়
বেশি স্বাধীন, তাদের
মানবাধিকার বেশি সম্মানিত,
তাদের নিরাপত্তা বেশি জোটে।
মুসলমানেরা মুসলমানের ভাই, এ
কথা বারবার ভুল প্রমাণিত হয়।
অধিকাংশ ধনী- মুসলমানদের
কোনও আগ্রহ নেই দরিদ্র-মুসলমানের
দারিদ্র ঘোচানোর।
সৌদি আরব গরিব মুসলিম দেশের
শুভাকাঙ্ক্ষী কখনও ছিল না, এখনও
নয়। শ্রমিক তারা নেয় বটে,
শ্রমিকের স্বার্থে নয়, নেয়
নিজেদের স্বার্থে। নিজেরা
নোংরা কাজ, ছোট কাজ, করতে চায়
না বলে নেয়।
সৌদি আরবের নারী বিদ্বেষী
পুরুষেরা নিজেদের নারীকেও
অসম্মান করে, বহিরাগত নারীকেও
অসম্মান করে। নারীরা সৌদি
আরবে ততদিন নিরাপদ নয় যতদিন
সৌদি পুরুষের মধ্যে নারী বিদ্বেষ
থাকবে, যতদিন নারীকে তারা
যৌনবস্তু বলে ভাববে। অদূর
ভবিষ্যতে সৌদি পুরুষদের
মানসিকতা আমূল বদলে যাওয়ার
কোনও সম্ভাবনা নেই।
যে নারীরা সৌদি আরবে শ্রমিক
হিসেবে যায়, তারা শ্রমিক, তারা
পতিতা নয়। অথচ তাদের পতিতার
মতো ব্যবহার করতে চায় পুরুষেরা।
স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে পরিচারিকার
ঘরে শুতে আসে গৃহকর্তা।
পরিচারিকা রাজি না হলে তার
ওপর চলে শারীরিক অত্যাচার।
কোথায় বাংলাদেশের সরকার
সৌদি সরকারকে বলে দেবে আমরা
মেয়ে পাঠাবো না, তা নয়, বলছে
মেয়েরা বাংলাদেশে আরও বেশি
নির্যাতিত।
তার মানে, মেয়েরা যেহেতু
বাংলাদেশেও নির্যাতিত, সুতরাং
সৌদি আরবে নির্যাতিত হলে
কোনও অসুবিধে নেই। পুরুষেরা
সাধারণত তাদের নারী বিদ্বেষ
জনসমক্ষে আড়াল করে, কিন্তু
বাংলাদেশের পুরুষদের এসব প্রকাশ
করতে এতটুকু লজ্জা হয় না। সৌদি
আরবের নারীবিদ্বেষী পুরুষেরা
বাইরের লোক, বাংলাদেশের নারী
বিদ্বেষী পুরুষেরা ঘরের লোক। ঘরে
যারা মেয়েদের নির্যাতন করে,
বাইরেও মেয়েরা নির্যাতিত হলে
তাদের কিছু যায় আসে না।
আমি ঘরের অত্যাচার মেনে নিয়ে
বাইরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ করছি না। আমি ঘর এবং
বাইরের দু’রকম অত্যাচারের
বিরুদ্ধেই লড়তে চাইছি।
লেখক: কলামিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন