গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে
বানিয়াচংয়ের নারীরা
জসিম উদ্দিন, বানিয়াচং
প্রতিনিধি ::
পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে চলেছে
বাংলাদেশ। একটা সময় ছিল যখন
বাংলাদেশের নারীরা বাড়ির
বাইরে কাজে যেতে পারতেন
না। বাড়ির গৃহস্থালির কাজ আর
রান্নাঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই
বন্দি ছিল তাদের জীবন। কিন্তু
কালের বিবর্তনে পৃথিবীতে
পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন
এসেছে আমাদের বাংলাদেশেও।
আমাদের দেশের নারীরা এখন
আর চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি
নেই। তারা এখন বাড়ির বাইরে
পুরুষের সাথে হাতে-হাত, কাঁধে-
কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।
অফিস-আদালত থেকে শুরু করে
একেবারে মাঠে-ঘাটে কাজ
করছেন নারীরা। শহরের
মেয়েদের সাথে প্রতিযোগিতায়
পিছিয়ে নেই আমাদের গ্রামের
মেয়েরাও। এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম
বানিয়াচংয়ের এমনই তিনজন
মেয়ের কথা এখানে তুলে ধরার
চেষ্টা করা হয়েছে, যারা গাড়ি
চালনার মত চ্যালেঞ্জিং
পেশাকে তাদের জীবিকা
নির্বাহের পথ হিসেবে বেছে
নিয়েছেন।
সংসার নামক গাড়ির স্টিয়ারিং
এখন সোমার হাতে : নাম সোমা
আক্তার। বয়স ১৮ বছর। মা জুলেখা
বেগম। বাবা মো. হাবিব মিয়া।
চার ভাই-বোনের মধ্যে সোমা
সবার ছোট। বানিয়াচংয়ের
দত্তপাড়া বন্দেরবাড়ি গ্রামের
বর্গাচাষী বাবার সামান্য আয়ে
সংসারে ছিল টানাপোড়েন।
অভাবের সংসারে এসে যোগ দেন
স্বামীর নিয়মিত নির্যাতনে
অতিষ্ট বড় বোন রুমা বেগম।
সংসারের হাল ধরতে সোমা বড়
বোনের সাথে মুদি দোকান
চালাতেন। তা দিয়ে সংসার
কোনরকম চলছিল। ২০১৪ সালের
জেএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর
হঠাৎ সোমা জানতে পারেন
ব্র্যাক সেন্টারে নারীদের গাড়ি
চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
সোমা আর দেরি করেননি। ছুটে
গেলেন ব্র্যাক সেন্টারে। ভর্তি
হয়ে যান ড্রাইভিংয়ে। ওই
বছরেরই নভেম্বর মাসে দক্ষতার
সাথে সম্পন্ন করেন গাড়ি
ড্রাইভিং। পরে ২০১৫ সালের
শুরুতে গাড়িচালক হিসেবে
চাকরি পেয়ে যান ঢাকার একটি
বায়িং হাউজে। সেখানে দুই বছর
চাকরি করার পর বর্তমানে ডাক
বিভাগের অধীনে ঢাকার জিপিও
বক্সে ওভারটাইমসহ মাসিক প্রায়
৩০ হাজার টাকা বেতনে সরকারি
গাড়ি চলাচ্ছেন তিনি।
গাড়ি চালনার মত পেশা কেন
বেছে নিলেন জানতে চাইলে
সোমা জানান, ‘ছোটবেলা
থেকেই চেয়েছিলাম ব্যতিক্রম
কিছু করব। আমি বিশ্বাস করি
সুযোগ পেলে গ্রামের নারীরা
পুরুষের মতই যেকোনো কাজ করতে
পারে।’ সোমা জানান, ‘শুরুতে
গ্রামের মানুষ অনেক সমালোচনা
করত।’ কিন্তু যারা সমালোচনা
করত তাদের কাছে সোমা এখন
আদর্শ। মানুষ এখন আর সমালোচনা
করেনা। নিজের পরিবারের
পাশাপাশি বড় বোনের সন্তানসহ
বরণপোষনের দায়িত্ব নিয়েছেন
সোমা। সোমার স্বপ্ন বাড়িতে
একটি পাকা ঘর বানাবেন,
যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন
নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস
করবেন। বর্তমানে সোমার
সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
সংসার নামক গাড়ির স্টিয়ারং
এখন সোমার হাতে।
নাহিদার ইচ্ছাকে সম্মান
দিয়েছেন বাবা-মা :
বানিয়াচংয়ের দেওয়ানদিঘীর
দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দা নাহিদা
আক্তার। বয়স ২২ বছর। বাবা
পেশায় কৃষক, মা গৃহিণী। স্থানীয়
একটি মহিলা মাদ্রাসায়
পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণী
পর্যন্ত। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে
বাংলাদেশ উন্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি
পাস করেন নাহিদা। ২০১৪ সালের
১ জুলাই ভর্তি হন ব্র্যাক ট্রেনিং
সেন্টারে। ৬ মাসে ট্রেনিং
শেষে দক্ষতার সাথে শিখে নেন
গাড়ি ড্রাইভিং। এরপরে আর
পিছন ফিরে থাকাতে হয়নি।
সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে চলে
যান ঢাকা। শুরুতে ৬-৭ হাজার
টাকা বেতনে বুয়েটের এক
শিক্ষকের গাড়ি চলাতেন।
বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি
বেতনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক
দন্তচিকিৎসকের গাড়ি চালাচ্ছেন
তিনি। নাহিদার স্বপ্ন সোমার
মতোই কোনো সরকারি চাকরি
করা। গাড়ি চালাতে কতখানি
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, জানতে
চাইলে নাহিদা জানান, শুরুতে
কিছুটা অস্বস্থিবোধ করতেন।
পাড়া-প্রতিবেশিরাও
সমালোচনা করত। কিন্তু এখন
এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে
দাঁড়িয়েছে। এখন মানুষের
সমালোচনা আর নাহিদার কাছে
ভিড়তে পারে না। ঢাকার
রাস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে গাড়ি চলান
তিনি। গাড়িচালকের প্রশিক্ষণ
নিতে পরিবার থেকে কোনো
প্রতিবন্ধকত সৃষ্টি হয়নি। এ
প্রসঙ্গে নাহিদা বলেন, ‘আমি
কৃষক পরিবারের মেয়ে হলেও
আমার বাবা-মা উদার মনের
মানুষ। মেয়ে বলে কখনও আমার
কোনো কাজে বাধা দেননি।
আমার ইচ্ছাকে সম্মান
দিয়েছেন।’ এ ধরনের জীবিকা
বেছে নেয়ার পেছনের কারণ
সম্পর্কে নাহিদা জানান, তিনি
গাড়ি চালক হওয়ার পর সংসারে
অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরে
এসেছে। সংসারে তার মা-বাবা
খুবই খুশি। মেয়ে রোজগার করে
সংসার চালাচ্ছে এর ছেয়ে আর
আনন্দের কি হতে পারে!
জেদ থেকে জীবনযুদ্ধে জয়ী
শেলী : নাম শেলী আক্তার। বয়স
২৬ বছর। বানিয়াচং উপজেলার
দৌলতপুর গ্রামের পূর্বপাড়ের
বাসিন্দা তিনি। পড়াশোনা
অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। বাবা আব্দুস
সাত্তার, মা তারা বানু। বাবা-
মা কেউই বেঁচে নেই। আট ভাই-
বোনের মধ্যে শেলীর স্থান ষষ্ঠ।
২০১৪ সালে ওমান প্রবাসী স্বামী
দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরে টাকা-
পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দেন তার
স্বামী। নিজের ভিতরে এক
ধরনের জেদ চেপে বসে শেলীর।
শুরু হয় নতুন করে জীবনযুদ্ধ। ভেবে
পাচ্ছিলেন না কি করবেন। হঠাৎ
খবর পেলেন এনজিও প্রতিষ্ঠান
ব্র্যাক বিনা ফিতে মেয়েদের
ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে
থাকে। দেরি না করে ভর্তি হয়ে
গেলেন সেখানে। ৬ মাসের
প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়ে ওঠেন দক্ষ
চালক। এরপর চলে যান ঢাকায়।
চাকরিও পেয়ে যান সেখানে।
বর্তমানে ঢাকায় পানি উন্নয়ন
বোর্ডের অফিসের গাড়ি
চলাচ্ছেন তিনি। সব মিলিয়ে
মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা
বেতন পাচ্ছেন। সংসারে এক
ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখে আছেন
শেলী আক্তার।
সড়কে মহিলা গাড়িচালক
হিসেবে কতটুকু নিরাপদ জানতে
চাইলে সোমা, নাহিদা ও শেলী
জানান, যদিও সড়কে গাড়ি
চালনার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়
চালককেই সতর্ক হয়ে গাড়ি
চালানো উচিত, তারপরও তারা
মনে করেন আমাদের দেশে পুরুষ
চালকদের চেয়ে নারী চালকরা
সাধারণত একটু বেশি সতর্ক হয়েই
গাড়ী চালায়। মেয়েরা ট্রাফিক
নিয়ম মেনে চলে। তারা জানান,
৩/৪ বছরের গাড়ি চালনার
ইতিহাসে তাদের একটিও দুর্ঘটনা
ঘটেনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন